দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্র ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে চলতি বোরো মওসুমে অগভীর নলকলগুলোতে পানি উঠছে না। বিএডিসির হিসাবে সারাদেশে ৪ লাখেরও বেশি সেচযন্ত্র অকার্যকর হয়ে গেছে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। স্মরণকালের ভয়াবহ পানি সংকট চলছে বৃহত্তর রংপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত এককালের প্রমত্তা তিস্তা নদীতে। হাজার হাজার একর বোরো ধানের চারা শুকিয়ে যেতে বসেছে, মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পরিত্রাণের পথ খুঁজছেন এ অঞ্চলের রাজনীতিকরা। এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিস্তার পানির নায্য হিস্যা আদায়ে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করবেন বলে তারা জানিয়েছেন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি প্রসঙ্গে উজানের দেশ ভারতের যে প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে, তা গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সময় অতিবাহিত হচ্ছে। উজানে গজলডোবা বাঁধে পানি প্রত্যাহারের বিষয় যখন আলোচিত হচ্ছে, তখন আরও বেশি করে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ভারত। বাঁধ, ব্যারাজ, পোল্ডার, স্লুইস গেট দিয়ে যৌথ নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ও পানির প্রবাহ বিঘিœত করা হচ্ছে এবং ক্যানালের সাহায্যে পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। বড় ধরনের রিভার-লিংকিং প্রজেক্ট করে ব্যাপকভাবে পানি প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে। অভিন্ন নদ-নদীতে ভারত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাঁধ দিয়েছে এবং আরও হাজার খানেক বাঁধের কাজ চলছে। পানির নায্য হিস্যা নিয়ে কোন আলোচনাই বাস্তবে কোন ফল দিচ্ছে না। বাংলাদেশের ৫৪টি যৌথ নদ-নদী আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৬০টি ছোট ও মাঝারি নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। শতাধিক নদী এখন মৃতপ্রায়। এতে ভাটির দেশ বাংলাদেশে জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীর পানির নায্য বণ্টন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করতে হবে। আর এই উভয়ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজকে সচেতন হয়ে সংশ্লিষ্ট তথ্য-তত্ত্ব নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদে সোচ্চার হতে হবে। নীতিনির্ধারক তথা রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ও অবস্থানের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নাগরিক সমাজের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। পানি সম্পদ ও নদ-নদী রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ তাগিদে পৌঁছার সময় এসেছে। কারণ নদ-নদীতে প্রতিবন্ধকতা ও বিপর্যয় সৃষ্টির ফলে যে বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে দেখা দেবে, তা শুধু ভাটির দেশ নয়, উজানের দেশকেও ভোগ করতে হবে। বাংলাদেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ কৃষি আবাদ, জীব-বৈচিত্র্য রক্ষাসহ সার্বিক অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে চায়, নীতিনির্ধারকরা যৌথ নদ-নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে যুতসই ও কঠোর অবস্থান নেবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বিদ্যমান পানি সংকট নিরসনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চল থেকে নোনা পানি উজানের দিকে আসছে। এর অন্যতম কারণ উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ হ্রাস, স্রোতহীনতা সৃষ্টি। নোনা পানির উজানে চলে আসায় কৃষি আবাদ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, জীব-বৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং নিরাপদ পানি মারাত্মক সংকট দেখা দিচ্ছে। বিশ্বে নিরাপদ পানি সংকটের কবলে পতিত দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে দুই কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ নিরাপদ, সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। গবেষকদের মতে, শতকরা প্রায় ২৪ ভাগ রোগ পানিবাহিত। পানিবাহিত রোগের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের শিশুরা। এমনকি রাজধানী নগরীতেও প্রায় ৪০ শতাংশ বস্তিবাসী বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৩টিই আর্সেনিক আক্রান্ত। তিন কোটিরও বেশি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।
বাংলাদেশের পানি সংকট দ্রুত মারাত্মক পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। নদীবহুল এই দেশে বদলে যাচ্ছে নদী পাড়ের জীবন-জীবিকা। পানি সংকট নিয়ে জরুরিভিত্তিতে আলোচনা-পর্যালোচনা, গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। যৌথ নদ-নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার মাধ্যমে পানির নায্য হিস্যা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলায় আঞ্চলিক পর্যায়ে উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে নদ-নদী ড্রেজিং করে নৌ-চ্যানেল ঠিক রাখার পাশাপাশি বর্ষার পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও সুবিধা-বঞ্চিত মানুষসহ সকলের জন্য নিরাপদ বা সুপেয় পানি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব জেলা আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে, সেসব জেলায় জনগণ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আর্সেনিক দূষণ রোধের কর্মসূচী জোরদার করতে হবে। ব্যবহৃত পানিকে পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করে তোলায় মনোযোগী হতে হবে। গৃহস্থালি থেকে শিল্প-কারখানা- সর্বত্র পানির অপচয় রোধ করতে হবে। পানি ব্যবহারে জনগণ পর্যায়ে এখনই সর্বোচ্চ সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।