তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি: উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। দিন দিন এ অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের লাল মাটিতে চাষাবাদের একমাত্র ভরসা ‘বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বসানো গভীর নলকূপ। এসব গভীর নলকূপের সাহায্যে কৃষক তাদের লাল মাটিতে সোনার ফসল উৎপাদন করে ঘরে তোলেন। যেখানে আগে কোন ফসলই ফলতো না সেখানে এখন কৃষক ইরি বোরো চাষাবাদ করে শত শত মণ ধান উৎপাদন করে থাকেন। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক গভীর নলকূপে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। এরই মধ্যে এ অঞ্চলের পানির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় দুইশ’ গভীর নলকূপে। এছাড়া পানির অভাবে এলাকাগুলোর ৫ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তথ্যে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অব্যাহতভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে এ অঞ্চলের উঁচু এলাকার প্রায় দুইশ’ অর্থাৎ ১৮০টি গভীর নলকূপ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। আর অল্প পরিসরে কিছু পানি উঠছে বা নাজুক অবস্থায় রয়েছে প্রায় ১২০টি গভীর নলকূপ। এদিকে একদম বন্ধ হয়ে যাওয়া নলকূপগুলোর আওতায় থাকা ৫ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনের জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে গত আশির দশক থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করা হয়। সেই পানি ব্যবহার করে খরা মৌসুমে অনাবাদি থাকা জমি আনা হয়েছিল চাষের আওতায়। কিন্তু অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে এখন হিতে বিপরীত দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে দুই ফুট করে পানির স্তর বা লেয়ার নিচে দিকে নেমে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা হওয়ার কারণে পানি সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সংশিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলাকে বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৫ সাল থেকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে ১৫ হাজার ১০৫টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে উঁচু এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর ও পতœীতলা উপজেলা। রাজশাহী তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা মৌজার গভীর নলকূপ অপারেটর সিরিনা সাংবাদিকদের জানান, তার বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এর গভীর নলকূপটি ২০০২ সালে স্থাপিত করা হয়। তখন মাত্র ১২৫ ফিট নিচে পানির স্তর পাওয়া গিয়েছিল। এখন ওই গভীরতায় আর পানি উঠছে না। চলতি মৌসুমে বন্ধ হয়ে আছে গভীর নলকূপটি। এতে তার নলকূপের আওতায় ২৫০ বিঘা জমি অনাবাদি পড়ে আছে। তিনি আরও জানান, বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনঃখননের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু ১৬০ ফিট নিচে গিয়েও পানির স্তর পাওয়া যায়নি। ফলে কোনোভাবেই চালু করা যায়নি নলকূপটি। একই অবস্থা উপজেলার কলমা গ্রামের কৃষক বদিউল ইসলাম বদি জানান, কলমা মৌজার বিএমডির গভীর নলকূপটিতে পানি কম ওঠার কারণে চলতি বোরো আবাদসহ ধান চাষ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অল্প পানি ওঠার কারণে অল্প সংখ্যক জমিতে রবি শস্য চাষ হচ্ছে। এতেও খরচ হচ্ছে দ্বিগুণ বেশি। এছাড়াও এ উপজেলার বৌদ্দপুর মৌজায় বিএমডির গভীর নলকূপ অপারেটর আব্দুল আজিজ সাংবাদিকদের জানান, তার মৌজার গভীর নলকূপটি পানির অভাবে বিগত দুই বছর ধরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। এতে দুই শতাধিক বিঘার উপরের বেশি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে বলে জানান তিনি। বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি শাসন ব্যবস্থা ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্ট্যাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম। এ ব্যাপারে তিনি জানান, ১৯৮০ সালে পানির স্তর মাত্র ৩৯ ফুট নিচে পাওয়া যেত। ২০১৬ সালে এসে এসব এলাকায় পনির স্তর মিলেছে ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট নিচে। এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩৫ বছরে প্রায় ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। তিনি আরও জানান, দেশে বছরে গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এই এলাকাগুলোতে গড় বৃষ্টিপাত ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় রিচার্জের হার সারা দেশে ২৫ শতাংশ হলেও উত্তরাঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ বলে জানান এই গবেষক। এনিয়ে তানোর উপজেলা বিএমডিএ প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, তানোরসহ পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ১২০ থেকে ১৩০ ফুট ডাউন দিয়ে গভীর নলকূপগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। সেই সময়ের উঁচু এলাকার গভীর নলকূপগুলোর অনেকগুলো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো আবার ১৬০ থেকে ১৭০ ফুট গভীরতা বোরিং করে সংস্কার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।