পরিবেশবাদিরা তাদের গবেষনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের অদুর ভবিষ্যতে পানির চরম সংকট দেখা দিবে বলে আসছিল অনেক আগে থেকেই। তাদের গবেষনা বাস্তবে রুপ নিতে শুরু করেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর বিগত এক যুগে দ্বিগুনের বেশি নিচে নেমে গেছে। অনেক আগে থেকেই উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায় পানির সংকট দেখা দিলেও এখন তা চরম আকার ধারন করেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়নকে ওয়াটার ট্রেস এরিয়া (পানি সংকটপূর্ণ ইউনিয়ন) ঘোষণা করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর তলানিতে নামায় বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডাব্লুউআরএম) জরিপে বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকাকে নিরাপদ পানির অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংস্থাটি ওই ইউনিয়ন এলাকায় সব গভীর নলকুপে থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করতে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রস্তাবনা পাঠালে যে কোন সময় বাধাইড় ইউনিয়ন থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করার ঘোষণা আসতে পারে সরকারের পক্ষে থেকে। পরিবেশবাদিরা এ পানি সংকটের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ স্থাপন করে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনকে অনেকাংশে দায়ি করেছে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। ১৯৮৫ সাল থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করে। বরেন্দ্র অঞ্চল ১৫ হাজার ১০৫টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে উচু এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়মতপুর ও পতিœতলা উপজেলা। এই সব উচু এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এত নিচে নেমেছে যে গত কয়েক বছরে বিএমডিএর প্রায় ১৮০ টি গভীর নলকূপ পুরোটা বন্ধ হয়ে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্ট্যাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি শাসন ব্যাবস্থা ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক গবেষনা থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সালে এ অঞ্চলে পানির স্তর মাত্র ৩৯ ফুট নিচে পাওয়া যেত। ২০১৬ সালে এসে এই সব এলাকায় পনির স্তর মিলেছে ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট নিচে। পনির স্তর ৩৫ বছরে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। তিনি আরো জনান, দেশে বছরে গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এই এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় রিচার্জের হার সারা দেশে ২৫ শতাংশ হলেও উত্তরাঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ। সম্প্রতি এক সেমিনারে বিএমডিএর চেয়ারম্যান ড.আকরাম হোসেন চৌধুরী জানান, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমে নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি মন্ত্রালয়ের নির্দেশ আছে যে, বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে আর গভীর নলকূপ স্থাপন করা যাবেনা। রাজশাহী জেলার ইউনিয়নগুলোর মধ্যে তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়ন বেশি উচু। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামায় এ ইউনিয়কে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ ইউনিয়নের হিসাবে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এর তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচে নামায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩টি পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়ানকে অতি ঝুঁকিপুর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডাসকো ফাউন্ডেশন পরিচালিত সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডাব্লুউআরএম) নামে একটি প্রকল্প জরিপ চালিয়ে এসব এলাকা চিহ্নিত করেছে। দীর্ঘ ১ বছর বরেন্দ্র অঞ্চল জুড়ে জরিপ চালিয়ে সরকারকে এমনই প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন আইডাব্লুউআরএম নামের সংস্থাটি। ২০১৪ সালে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ে এই জরিপটি পরিচালনা করেন। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এক যুগ আগে এ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফিটের মধ্যে সচারচর পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে তা ১৬০ ফিট বা তারও নিচে গিয়ে পানি মিলছে। ঝুঁকিপুর্ণ ওইসব পৌরসভা ৩টি হলো রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌরসভা, গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পৌরসভা। এছাড়া ১৫টি ইউনিয়নগুলো হলো, রাজশাহী তানোর উপজেলার বাঁধাইড, কলমা, পাঁচন্দর, গোদাগাড়ী উপজেলার মোহনপুর, পাকড়ী, গোদাগাড়ী ইউনিয়ন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার, গোবরা তলা ও ঝিলিম ইউনিয়ন, নাচোল উপজেলার কসবা ও নেজামপুর ইউনিয়ন, ভোলাহাটের দলদলি ইউনিয়ন, গোমাস্তাপুরের পাবতীপুর, রহনপুর, রাধানগর ইউনিয়ন। বাঁধাইড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, একযুগ আগেও ইউনিয়নে কুপ, টিউবওয়েল দিয়ে মানুষ তাদের প্রয়োজনিয় খাওয়ার পানি ব্যবহার করেছে সহজেই। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামাই বর্তমানে ইউনিয়ন এলাকায় কুপ ও টিউবওয়েল পানি শূণ্য হয়ে পড়ে আছে। এখান কার মানুষের একমাত্র খাওয়ার পানি ভরসা গভীর নলকুপ ও সাব-মার্সেবল পাম্প। তাও বেশি পানি উঠেনা। বিএমডিএ তানোর জোনের প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী জেলার অন্যসব ইউনিয়নের চেয়ে বাঁধাইড় ইউনিয়ন সবচেয়ে উচু অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পানির স্তর দ্রুত নিচে নামাই এ ইউনিয়নকে নিয়ে চিন্তিত বিএমডিএ। ধানের বদলে অন্য কোন ফসল করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ প্রকৌশলী আরো জানান, বাঁধাইড় ইউনিয়নকে নিয়ে নতুন প্রকল্পে চিন্তা করছে বিএমডিএ। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহান্দা থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইউনিয়নে খাল-খনণ করে ও পুকুরে পানি সংরক্ষণ করা হবে। সেখান থেকে কৃষকদের সেচ সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আইডাব্লুউআরএম’র মাঠ পর্যায়ের তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ও মুন্ডমালা পৌরসভায় দায়িত্বে প্রাপ্ত কমিউনিটি মবিলাইর আগস্টিনা হাঁসদা জানান, ২০১৫ সাল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩৫টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভা নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি। এসব পৌরসভা ও ইউনিয়নে পানির স্তর পরিমাপ কুপ বসানো হয়েছে। যা প্রতি মাসে দুই বার করে মাপ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি দ্রত ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকায় নেমে যাচ্ছে। সংস্থাটির রাজশাহী অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, এক যুগ আগেও উল্লেখিত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেতো। বর্তমানে তা ১৬০ ফুট বা তারও নিচে না গেলে পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাগুলোতে দ্রুত গভীর নলকূপের পানি দিয়ে বোরো আবাদ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে পানির রিচার্জ করতে বিদ্যমান বড় পুকুর ও খাড়ি খনন করে ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। এ কর্মকর্তা আরো জানান, বাধাইড় ইউনিয়নকে সরকার পানি সংকটপূর্ণ এলাকা হিসাবে ঘোষনা করলে এ ইউনিয়নে আর কোন গভীর নলকুপ দিয়ে পানি তুলতে পারবেনা। এর আগে বাধাইড় ইউনিয়নে সংস্থার পক্ষে চলতি বছরেই আরো ১০০টি মতো পানির স্তর পরিমাপ কুপ পরীক্ষা করা হবে। এ ইউনিয়নের পর দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে।

Link