মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সঙ্কট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে সর্বত্রই পানির জন্য হাহাকার সৃষ্টি হয়। সেচের অভাবে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি পতিত থাকছে। শহরে-গ্রামে খাবার পানিরও অভাব তীব্র হচ্ছে। এবার শুষ্ক মৌসুমের আগেই নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে সঙ্কট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার নীতি এর অন্যতম কারণ। ফলে বরেন্দ্র ভূমি মরুময়তার দিকে এগুচ্ছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালে যে পরিমাণ বৃষ্টিহচ্ছে, সঠিক ব্যবস্থাপনায় সেই পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে আরও তত্পর হতে হবে। অন্যথায় গোটা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য মতে, গত ২৫ বছরে এ অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ৩৫ থেকে ৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। এ স্তর আর ২৫ ফুট নিচে নামলেই পানির বদলে গভীর নলকূপের পাইপ পাথরে ঠেকবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যেই পানির স্তর আরও ২৫ ফুট নিচে নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকৌশলীরা।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত আট বছরে বরেন্দ্র ভূমির বিভিন্ন জায়গায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে ব্যাপকভাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পানির স্তর নেমে যাওয়ার পরিমাণ বছরে গড়ে একমিটারের কাছাকাছি। উচ্চ বরেন্দ্র ভূমি এলাকার মুণ্ডুমালা পৌর এলাকায় গত ৮ বছরে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে বছরে একমিটার হারে। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি পানি পাওয়া গেছে ১৩ দশমিক ২৪ মিটার নিচে। তার পরের বছর ২০০৩ সালের ৬ জানুয়ারি পানি পাওয়া গেছে ১৪ দশমিক ৮৪ মিটার নিচে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার জন্য দায়ী করা হচ্ছে বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৮ হাজার গভীর নলকূপকে। ভূ-উপরিস্থিত পানি ব্যবহার করে এ অঞ্চলে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৬২ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড পদ্মা মহানন্দার পানি ব্যবহার করে বরেন্দ্র সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য চিন্তা-ভাবনা শুরু করে।এ ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে জাপানের একটি সংস্থা ভূ-উপরিস্থিত পানি ব্যবহার করে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করে।

সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপরীতে বরেন্দ্র ভূমি সমস্যায় পড়বে। বিশেষজ্ঞদের এই অভিমতের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তানোরের মুণ্ডুমালা এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানি নেমে যাওয়ার এই পরিসংখ্যানে। এক সমীক্ষায় ২০০৪ সালের ৫ জানুয়ারির রিডিংয়ে দেখা যাচ্ছে, পানি পাওয়া গেছে ১৫.৩৮ মিটার নিচে। ২০০৫ সালের ২ জানুয়ারির রিডিং অনুযায়ী পানি পাওয়া গেছে ১৬.৮৫ মিটার নিচে। ২০০৬ সালের ২ জানুয়ারি পানি পাওয়া গেছে ১৭.৯৫ মিটার নিচে। ২০০৭ সালের ৭ জানুয়ারি পানি ছিল ১৮.৯৯ মিটার নিচে। ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি পানি ছিল ১৯.৪৯ মিটার নিচে এবং ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি ২০ দশমিক ৪৪ মিটার নিচে এবং ২০১০ সালে পানির হদিস মিলেছে ২১ দশমিক ২২ মিটার নিচে।

বৃষ্টির দিক থেকে বরেন্দ্র ভূমি মৌসুমী বায়ুর কম আশীর্বাদ পেয়ে থাকে। গত ১০ বছরের বৃষ্টির যে রেকর্ড, সে অনুযায়ী এ এলাকায় গড়ে বৃষ্টির পরিমাণ মাত্র ১৪০০ মিলিমিটার। এই বৃষ্টির ৭৫ শতাংশ হয় বর্ষা ঋতুতে অর্থাত্ জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে।

বছরের অন্যান্য সময়ে এই অঞ্চলে শুষ্ক ভাব বিরাজ করে। শীতকালে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামার রেকর্ডও রয়েছে। ফলে এ বছর বিএমডিএর আওতাধীন বড় একটি অংশ বোরো মৌসুমে পানি পাবে না। এর আগেই এই এলাকার চাষীদের ধানের পরিবর্তে কম পানি প্রয়োজন হয় এমন ফসল—যেমন গম, ছোলা চাষের ব্যাপারে উত্সাহিত করা হয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সব উপসর্গ এই এলাকায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জামাত খান বলেন, রাজশাহী তথা বরেন্দ্র ভূমিতে অপরিকল্পিতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে পানির স্তর নেমে গেছে। দেখা দিচ্ছে আর্সেনিক সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফান্ডে এ অঞ্চলের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এদিকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মরণ ফাঁদ ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব, গভীর নলকূপের সাহায্যে নির্বিচারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং বৃষ্টি কমে যাওয়াসহ নানা কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়ছে এ অঞ্চল। সেচ ঝুঁকিতে এ অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. সারওয়ার জাহান বলেন, বর্ষায়ও যেখানে পদ্মায় পানি থাকে না, সেখানে ভূ-গর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনই কোনো ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই বরেন্দ্র অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। এজন্য চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। অন্যদিকে বর্ষাকালে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

Link