ঘড়ির কাঁটায় বেলা দুইটা। একটি গভীর নলকূপের সামনে কলস হাতে দাঁড়িয়ে আছেন জনা পঁচিশেক নারী। ২০ মিনিট পর ট্যাপ থেকে পানি পড়তে শুরু করল। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা, তারপর একটু বেশি। প্রতি কলস পানি পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে এভাবে সংগ্রহ করতে হচ্ছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার ঝিনাইখোর গ্রামের মানুষকে। এই চিত্র গত ৭ ফেব্রুয়ারির। শুধু ঝিনাইখোর নয়, উঁচু বরেন্দ্র এলাকার প্রায় সবখানেই এখন পানির জন্য হাহাকার। এই সংকট এখন আরও বেড়েছে। তানোরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানির স্তর এতটাই নেমে গেছে যে নলকূপ দূরে থাকুক কোনো কোনো এলাকায় গভীর নলকূপেও পানি ওঠে না। পানির অভাবে ফসলের আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকায়। কোথাও পানি নিয়ে সংঘাত হয়েছে। পানি না পেয়ে এলাকা ছাড়ছে মানুষ। গবেষকেরা বলছেন, কৃষিতে ব্যবহারের জন্য বরেন্দ্র এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি বেশি বেশি উত্তোলন করায় পানির স্তর গড়ে প্রায় দুই ফুট নেমে যাচ্ছে। এর ফলেই পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। এর মধ্যে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলা উঁচু বরেন্দ্র এলাকা। ১৯৮৫ সাল থেকে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার শুরু করে। এখন বরেন্দ্র এলাকায় বিএমডিএর ১৫ হাজার ১০০টি গভীর নলকূপ চালু রয়েছে। বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, সরকার নীতিগতভাবে কৃষিকাজের জন্য আর ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর থেকে বিএমডিএ নতুন করে আর নলকূপ বসাচ্ছে না। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানায় গভীর নলকূপ এখনো বসানো হচ্ছে। এ জন্য উপজেলা সেচ কমিটির অনুমতি নেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি শাসনব্যবস্থা ও টেকসই উন্নয়ন’ বিষয়ে গবেষণা করছেন। তিনি গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ১৯৮০ সালে পানির স্তর মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। এই এলাকায় ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটা পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে। এ পানি হস্তচালিত বা গভীর নলকূপে উঠছে না। রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এই এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এই অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ। তানোর পৌর মোড়ের দোকানি টুটুল বিশ্বাস বলেন, স্থানীয় মাদ্রাসায় একটি ‘সাবমার্সিবল পাম্প’ রয়েছে। সেখানে মাসিক চুক্তিতে টাকা দিয়ে পানি আনতে হয়। তাদের সঙ্গে মাসিক চুক্তি রয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলে বা পাম্প নষ্ট হলে বেকায়দায় পড়তে হয়। তখন ৪০ টাকা দিয়ে ১০৫ লিটারের এক ড্রাম পানি কিনতে হয়। আনতে ভ্যান ভাড়া লাগে ১৫ টাকা। জানা গেল, চার বছর আগেই এই এলাকায় পানি নিয়ে মানুষের মধ্যে মারামারি হয়েছে। পাওয়া গেল সেই মারামারিতে আহত যুবক এহসান আলীকে। তিনি বলেন, পানি নিয়ে দুই কাউন্সিলরের লোকজনের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। তিনি একজনকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন। তাঁর হাত-পা ভেঙে যায়, ফেটে যায় মাথা। দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন। এখনো পায়ের ভেতর লোহার রড আছে। তানোরের রামদেবপুর আবাসিক এলাকায় ৮০টি পরিবারের জন্য আবাসন প্রকল্প করা হয়েছিল। পানির অভাবে এলাকায় আবাদ না হওয়ায় প্রায় অর্ধেক পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। গুচ্ছগ্রামে এখনো রয়েছেন লক্ষ্মী মুরমু ও সোনা মুরমু নামের দুই বৃদ্ধ। লক্ষ্মী বললেন, ‘পানি নেই। কাজ নেই। মানুষ থাকতে পারছে না।’ তারা দুই বোন মানুষের বাড়িতে চেয়ে খান বলে জানান। চিনাসো গ্রামের নুরুল ইসলাম গভীর নলকূপের অপারেটর। তিনি বললেন, নতুন করে তুলে বসানোর পরে তার নলকূপে আর আগের মতো পানি উঠছে না। বোরো আবাদ তাঁরা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। পাঁচন্দর গ্রামের কৃষক মাসুদ রানাও আবাদ কমিয়ে দেওয়ার কথা জানান। তানোরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সমশের আলী বলেন, তানোরে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৬০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন আরও ৬৫টি মিনি গভীর নলকূপ রয়েছে। পানি না পাওয়ায় প্রায় ১০টি নলকূপ তুলে নতুন জায়গায় বসানো হয়েছে। তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচ জায়গায় খুঁড়তে খুঁড়তে হয়তো এক জায়গায় পানির স্তর পাওয়া যায়। একদমই পানি না পাওয়ায় মাহালেপাড়ার গভীর নলকূপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে নিরাপদ পানি সরবরাহের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের। এর অন্তর্ভুক্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রাক্কলন কর্মকর্তা প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাস গতকাল বলেন, গভীর নলকূপ না বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটা মানা হলে পানির স্তরের অবনমন রোধ করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতও হতে হবে।