রাজশাহী: বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান চাষ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। আর বাড়ছে রবি শষ্য।
কৃষকরা বলছেন, প্রতিবছর ধান চাষে লোকসানের ঘানি টানতে টানতেই তারা ক্লান্ত। আর তাই ধান ছেড়ে তারা এখন ঝুঁকছেন গম, আলু, পেঁয়াজ, মসুর ও ছোলাসহ বিভিন্ন রবি শষ্যে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান চাষে অতিরিক্ত সেচ খরচের কারণে ধানের উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না চাষিরা। এ জন্য ধানের আবাদ কমিয়ে তারা কম সেচের রবি শষ্য চাষে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৮০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বহু গভীর নলকূপ স্থাপন করে। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকের সেচ চাহিদা মেটাতে এসব গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে শুধু ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে চাষাবাদ চালিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। গভীর নলকূপ স্থাপনের শুরুর দিকে পানির স্তর মাটির ৩৫ ফুট গভীরে থাকলেও এখন স্থানভেদে পানির স্তর ১২০-১৪০ ফুট গভীরে পাওয়া যাচ্ছে।
আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলে এখন পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতেও হচ্ছে না। এতে ভূ-গর্ভের পানির রিচার্জ না হওয়ায় গভীর নলকূপ থেকে পানি উঠছে খুবই কম। অন্যদিকে বরেন্দ্র অঞ্চল অত্যন্ত খরাপ্রবণ এলাকা হওয়ায় এখানে ধান চাষে সেচের প্রয়োজন হয় অন্যান্য এলাকার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। আর বোরো চাষ হলে তো পানির প্রয়োজন আরো বেশি। এতে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় কৃষকের।
এ কারণে তারা এখন ধানের আবাদ কমিয়ে দিয়ে কম সেচ প্রয়োজন এমন রবি শষ্যর দিকে মন দিয়েছেন। এতে কিছুটা লাভেরও মুখ দেখছেন কৃষক।
রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলাকে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রধান এলাকা হিসেবে ধরা হয়। গোদাগাড়ী উপজেলায় প্রতিবছরই ধানের আবাদ কমছে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপজেলাগুলোতেও একই অবস্থা।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৪ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। যেখানে গত মৌসুমে বোরো চাষ হয়েছিল আরো এক হাজার ১৫০ হেক্টর বেশি জমিতে।
কৃষি বিভাগ মনে করছে, সেচ সংকট ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় গোদাগাড়ীতে প্রায় প্রতিবছরই ধানের চাষ কমছে।
এদিকে ধান চাষ কমলেও বাড়ছে রবি শষ্যর চাষাবাদ। চলতি রবি মৌসুমে গোদাগাড়ীতে মসুর ডাল দুই হাজার ৮৫০ হেক্টর, ছোলা এক হাজার ৫২৫ হেক্টর, গম ৮১০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এসব শষ্যর প্রতিটিরই চাষাবাদ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
উপজেলার কাপাটিয়া গ্রামের কৃষক বদর আলী জানিয়েছেন, এক বিঘা ধান চাষে খরচ হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার টাকা। এর বিপরীতে ধানের উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ মণ। এর মধ্যে থেকে ৪ মণ ধান শ্রমিকের মজুরি হিসেবে বাদ দিতে হয়। বর্তমান বাজারে বাকি ১৬ মণ ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। এ জন্য কৃষকেরা ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছেন।
এদিকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রবি শষ্য চাষেই বেশি লাভবান হচ্ছেন তারা।
কৃষকরা জানিয়েছেন, সেচহীন এক বিঘা মসুর ডাল চাষে কৃষকের সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২’শ টাকা খরচ হয়। আর বিঘা প্রতি মসুরের উৎপাদন কমপক্ষে ৪ মণ। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ মসুর বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮শ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
উপজেলার আতাহার গ্রামের কৃষক শামসুল হক জানান, এক বিঘা ছোলা চাষে খরচ হয় প্রায় ৪ হাজার টাকা। এর উৎপাদন বিঘায় ৫-৬ মণ। বর্তমান বাজারে প্রতিমণ ছোলা বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ২শ টাকা থেকে দুই হাজার ৫শ টাকায়। ফলে ছোলা চাষেও লাভবান হচ্ছেন কৃষক।
ওদিকে গম চাষি পিরিজপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছেন, তিনি এবার ৮ বিঘা জমিতে গম চাষ করেছিলেন। এতে তার প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। কয়েকদিন আগে গম কেটে ফলন পেয়েছেন বিঘা প্রতি ১২ মণ। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ ৯৬০ টাকা দরে গম বিক্রি করে এক বিঘার গমেই তিনি সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা লাভ করেছেন।
এদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান চাষ কমে যাওয়া এবং এর বিপরীতে রবি শষ্য চাষ বেড়ে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন গোদাগাড়ীর কৃষি কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো ধান চাষে প্রচুর সেচ লাগে। এতো সেচ আর অন্য কোনো এলাকাতে ধান চাষে লাগে না। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, সেচের চাহিদার প্রায় সবটুকুই মেটাতে হয় ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে। এতে দিন দিন বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কম সেচের রবি শষ্য চাষ কৃষকদের মাঝে আলোড়ন তুলেছে। এতে তারাও লাভবানও হচ্ছেন। অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপরও চাপ কমছে।