ধেয়ে আসছে ভয়াবহ পানি বিপর্যয়। দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর। আরো বেশ কয়েকবছর আগে থেকে দেশের শহরগুলোতে সুপেয় পানি নিয়ে সংকট দেখা দিলেও অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে ছিল উপকূলীয় জেলাগুলো। কিন্তু বর্তমানে উপকূলীয় জেলাগুলোতেও এখন পানীয় জলের সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এ নিয়ে আগামী দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিফ কেমিস্ট মো. আব্দুস সাত্তার মিয়াহ ঘটনার কথা স্বীকার বলেন, এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এখনি প্রস্তুতি না নিলে আগামীতে সুপেয় পানির সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়া এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপের কারণে এই সংকট বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, সরকার যদি পানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সাগর থেকে দূষণমুক্ত পানি উত্তোলন ও প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো সংরক্ষণে এখনি উদ্যোগ না নেয়, তাহলে সামনে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।

জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। একই অবস্থা বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোতেও। কিন্তু এক্ষেত্রে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার একসময় অনেক ভালো অবস্থানে থাকলেও সাম্প্রতিককালে এ শহরেও দেখা দিয়েছে সংকট। এমনকি উপ-শহরও গ্রামাঞ্চলেও পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েরর (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে প্রতিবছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ২ থেকে ৩ মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে ৫ বছর পরে প্রতিবছর ১০ মিটার করে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। অথচ সত্তরের দশকে যেখানে ভূ-গর্ভস্থ পানিতল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এক মিটারেরও কম গভীরতায় ছিল, বর্তমানে তা সর্বোচ্চ ৭০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে।

বিএডিসি জানায়, দেশের প্রায় ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল (শ্যালো মেশিন) দ্বারা সেচের জন্য পানি উত্তোলন করা হয়। কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে প্রায় ৪ লাখ শ্যালো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। কারণ শ্যালো মেশিন মাটির ওপর থেকে ২৬ ফুট নিচ পর্যন্ত পানি তুলতে পারে। আর পানির স্তর আরো নিচে চলে গেলে শ্যালো টিউবওয়েল পানি তুলতে পারে না। পানির স্তর অব্যাহত নিচে নামতে থাকলে একসময় শ্যালো টিউবওয়েলে পানি উঠবে না। সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে বিকল্প উৎস ব্যবহার করতে হবে।

আগামী দিনে সুপেয় পানির নিশ্চয়তা নিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কোনো আশার কথা শুনাতে পারছেন না। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটিতে মাত্র ৪১ ভাগ মানুষের পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হলেও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে না পারার কারণে এবং মৌসুম ভেদে পানি সংকটের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া শিল্পোন্নয়ন ও কৃষি কাজও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় সারা বিশ্বের সঙ্গে চলতি বছরও দেশে ২২ মার্চ পালিত হলো ‘বিশ্ব পানি দিবস’।

পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলছেন, একদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহার, অন্যদিকে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার কারণে পানির স্তর দিনদিন ভয়াবহ হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীনালা খালবিল, পুুকুরে পানি থাকে না। ফলে এই অঞ্চলের পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। একই কারণে বিল্ডিং বা স্থাপনার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং ভূমিধসের আশঙ্কাও রয়েছে। তা থেকে পরিত্রাণে সুপেয় পানি হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, নদীনালা, খালবিলের পানি সংরক্ষণ করে তা সেচসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করার উপর জোর দিচ্ছেন তিনি।

তিনি বলেন, অপরিকল্পিত নগররায়নের ফলে শহরগুলো হয়ে উঠছে কংক্রিটের শহর। যার ফলে পানি মাটি ভেদ করে নিচে পৌঁছাতে পারছে না। ইটের তৈরি ভবন গড়ে ওঠায় বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি মাটি শোষণ করে নিতে পারে না। এর আগেই তা খাল বা নদী নালায় চলে যাচ্ছে। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়ার এটাও একটা কারণ।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। অনেকের মতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৬০০টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি নদী আন্তর্জাতিক। যার ৫৪টিই এসেছে ভারত থেকে নেমে। বাকি ৩টি এসেছে মিয়ানমার থেকে। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ নাব্যতা হারিয়েছে।

জানা যায়, পৃথিবীতে পানির মাত্র ২.৫ শতাংশ মিঠাপানি। এ মিঠাপানির ৩০.১ শতাংশ পানি থাকে ভূ-গর্ভে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি মাঠ-ঘাট, রাস্তা, জলাশয় ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় ও সারাবছর আমাদের পানির চাহিদা মেটায়। সূক্ষ্ম বালিকণা ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় বলে এ পানি হয় বিশুদ্ধ। গভীর নলকূপের পানি এতটাই নিরাপদ যে তা না ফুটিয়েই খাওয়া যায়।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষ পানি নিয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে বাস করছেন। কারণ বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হলেও দেশের সাড়ে নয় কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে পারছে না।

হু জানিয়েছে, বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর পানির উৎস ভারত থেকে বয়ে আসা অভিন্ন নদীর পানি। কিন্তু দেশটিতে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ এবং পানির প্রাপ্যতা ভয়াবহভাবে কমেছে। মানুষের পানি প্রাপ্যতা এবং অপ্রাপ্যতাও ঋতুভেদে ওঠানামা করে। বর্ষায় পানির ঢল থাকলেও গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়। এর প্রধান কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের কোনো নদীতেই বর্ষার পানি ধারণের ব্যবস্থা নেই। ফলে গ্রীষ্মকালে পানিপ্রবাহ কমে আসায় সমুদ্রের পানি উঠে আসছে উজানে। এতে জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে, পানির চাহিদা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বাড়ছে। এতে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে বিশ্বে যে ১৫টি দেশ সবচেয়ে বেশি ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তাদের মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ইরানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।

সূত্র জানায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। দৃশ্যত মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে এগুচ্ছে এ অঞ্চলের সার্বিক আবহাওয়া। যা এ অঞ্চলের কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। খরা মৌসুমে রাজশাহীর নিকটবর্তী পবা উপজেলায় ১৯৮৫ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল গড়ে ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি। ১৯৯৫ সালে ৩০ ফুটের নিচে ও ২০১০ সালে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬ ফুটে। বরেন্দ্র অঞ্চল, বিশেষ করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় পানির স্তর প্রতি মাসে দশমিক ০০৪ থেকে দশমিক ০২৮ হারে নিচে নামছে। বর্ষাসহ বছরজুড়ে পরিমিত বৃষ্টিপাতের অভাব দেখা দিয়েছে এ অঞ্চলে।

Link