“তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,সব গাছ ছাড়িয়ে,উঁকি মারে আকাশে।…’’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা ‘তালগাছ’। কবিতাটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হয়। তালগাছ বইয়ের পাতায় দেখলেও মাঠে-ঘাটে কেউ কেউ দেখেছেন আবার অনেকেই দেখেননি।
কালের বিবর্তণে তাল গাছ হারিয়ে গেলেও নওগাঁর নিয়ামতপুরে এখন কালের স্বাক্ষী হয়ে শতশত তাল গাছের সারি রাস্তার দু’ধারে সৌন্দর্যবর্ধন করে যাচ্ছে। উপজেলার হাজিনগর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম ‘ঘুঘুডাঙ্গা’। হাজিনগর গ্রাম থেকে ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে যাওয়ার পথে হাজিনগরের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার দু’ধারে প্রায় ৬শ’ তাল গাছে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন ৫০ থেকে একশ’ জন বৃক্ষপ্রেমী ও ভ্রমন পিয়াসী আসেন এই তাল গাছ দেখতে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঠাঠা বরেন্দ্র ভ’মি নিয়ামতপুর, সাপাহার ও পোরশায় পানি সংকটের মধ্যেও আগে প্রচুর বড় বড় তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে সেইগুলো কেটে ফেলেন। এক সময় তালগাছগুলো বরেন্দ্র এলাকা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে স্থানীয় জনসাধারণ ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) সহযোগিতায় তাল গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সময়ের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। আকাশে মেঘ জমলে মানুষ আতংক হয়ে পড়ে। উচু গাছ না থাকায় বজ্রপাতে মানুষের প্রায় মৃত্যু হচ্ছে। পরিবেশ থেকে তালগাছ হারিয়ে যাওয়ায় এ বজ্রপাত বেড়ে গিয়ে মানুষের মুত্যু হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তণ, মাটির ক্ষয়রোধ, অনাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করতে তালগাছ রোপনের গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণত বজ্রপাত বেশী আঘাত হানে সাধারণত উচু গাছে। এ দিক থেকে তালগাছ বজ্রপাতের ঝুকি কমায়।
নওগাঁ বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশের পরম বন্ধু তালগাছ রক্ষায় জেলায় রাস্তাগুলোর দু’পাশ জুড়ে সারিসারি তালগাছ লাগান হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র রক্ষায় সেখানে ৩০ লাখের বেশি তালগাছ রোপণ করেছে বিএমডিএ। শক্ত-মজবুত আর দীর্ঘজীবী হওয়ায় শিশু, আম, জাম গাছের পরিবর্তে ৯ বছর ধরে বিভিন্ন রাস্তার পাশে এসব গাছ লাগানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
বিএমডিএ ছাড়াও জেলা মহাদেবপুর উপজেলার শিকারপুর গ্রামের মৃত গহের আলী ২০ বছর ধরে একক প্রচেষ্টায় নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের নওহাটা থেকে বেলি ব্রিজ এলাকা পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তাসহ আশেপাশে রাস্তায় প্রায় ১২ হাজার তাল গাছ রোপন করেন। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ২০০৯ সালে ৫ জুন জাতীয় পরিবেশ পদক-২০০৯ প্রদান করা হয়। গহের আলী পরিবেশ সংরক্ষণ ক্যাটাগরিতে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছ থেকে এই পুরুষ্কার গ্রহন করেন তিনি।
নিয়ামতপুরে উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের গৌতম কুমার সাহা ইত্যে মধ্যে মর্শিদপুর ইউনিয়নেরসহ আশে পাশের এলাকার রাস্তায় গত ৫ বছর থেকে প্রায় ১৫ হাজার গাছ রোপন করেছেন।
বিএমডিএ এর চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী জানান, ২০০৮ সাল থেকে জেলার বিভিন্ন রাস্তা ও খাড়ির পাশে প্রায় ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে ৩০ লাখের বেশি তালগাছ। বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, বদলগাছী, পত্মীতলা ও ধামুইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুইপাশে লাগানো হয়েছে এসব তালগাছ। তারপরেও তালগাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কালের বিবর্তণে সেই তাল গাছ হারিয়ে গেলেও নিয়ামতপুর উপজেলায় এখন কালের স্বাক্ষী হয়ে তাল গাছের সারি রাস্তার দু’ধারে সৌন্দর্য বন্ধন করে যাচ্ছে।
সরজমিনে দেখা জানা গেছে, নিয়ামতপুর হাজিনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে নওগাঁ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নওগাঁ-১ আসনের সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৯৮৩ সালে পরিষদের দায়িত্ব পালন কালে হাজিনগরের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার দু’ধারে প্রায় ৭শ’ তাল বীজ রোপন করেন। বেশ কিছু গাছ বিভিন্ন ভাবে মারা গেলেও এখনো প্রায় ৬শ’ তালের গাছ বেঁচে আছে। সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদারের রোপিত সেই তালগাছগুলি বর্তমানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সেই তালগাছগুলো বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ ফিট লম্বা হয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে রাস্তার দু’ধারে শোভা বন্ধন করে আসছে। এই তালেরগাছগুলো প্রতিদিন দেখতে অনেক দর্শক ও বৃক্ষপ্রেমীরা দেখতে আসেন।
পরিবারসহ নওগাঁ শহর থেকে তালগাছগুলো দেখতে আসেন উত্তম কুমার। তিনি জানান, এই সারিবদ্ধ তালগাছগুলোর ছবি ফেইসবুকে কয়েক মাস আগে দেখি। এরপর তালগাছগুলো দেখতে সময় করতে পারছিলাম না। নিয়ামতপুরে এক আতœীয়ের বাড়ি থেকে ফেরার সময় পরিবারের লোকজন নিয়ে ঘন্টাখানেক সময় কাটানো হলো। বেশ ভালো লাগলো। তিনি আরো বলেন, এ ধরনের সারিবদ্ধ তালগাছ সাধারণ কোথাও দেখা যায় না।
ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের ঐতিহ্য আমাদের অহংকার। আজ যখন তালগাছ হারিয়ে যেতে বসেছে তখন আমার গ্রামের রাস্তার দুধারে শত শত তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি।
হাজিনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে। আমি যখন ইউনিয়ন পরিষদ যাই তখন ঐ তালগাছ সমৃদ্ধ রাস্তায় আসলে নিজেকে অন্যরকম মনে হয়।
হাজিনগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও হাজিনগর গ্রামের বাসিন্দা সুরঞ্জন বিজয়পুরী বলেন, এ রকম তালগাছ এখন আর কোথাও দেখা যায় না। আমাদের এলাকায় এরকম তালগাছ সমৃদ্ধ রাস্তা থাকায় আমরা গর্বিত।
নিয়ামতপুর উপজেলা বিএমডিএ এর জোন সহকারী প্রকৌশলী মতিউর রহমান বলেন, ‘তাল একটি ঔষধি গুণ সম্পন্ন ফল। গাছও খুবই শক্ত, ঝড়ে ভাঙে না। ফসলের শেল্টার বেল্ট হিসেবে কাজ করে। তালগাছ ভূমি রক্ষায় কাজ করে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীব বৈচিত্র রক্ষায় ভূমিকা রাখে।’
নওগাঁর বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক জানান, তাল বীজ রোপণের মধ্য দিয়ে এ এলাকায় সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি তাল উৎপাদন ও রস সংগ্রহের মধ্য দিয়ে এলাকার সামাজিক উন্নয়ন হবে।
তিনি আরও জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে এক সময় গাছপালা খুব কম ছিল। সে সময় গ্রামগঞ্জে শুধু তালগাছ চোখে পড়ত। কিন্তু কালের পরিবর্তনে তালগাছ বাদ দিয়ে মানুষ শিশুসহ নানা রকম কাছ লাগানো শুরু করেন। তবে ২০০৮ সালে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে তালগাছের চারা লাগানো প্রকল্প গ্রহণ করে।
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী আরো বলেন, মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দূর্যোগ ও প্রশমন দিবসে তালগাছ রোপনের উপর জোর তাগিদ দেন। কারণ তালগাছই ভূমিক্ষয়, ভূমিধ্বস রোধ, ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। তালগাছ মেঘ আকর্ষণ করে এবং বৃষ্টিপাত হয়। তালগাছ পরিবেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তালগাছ না থাকায় আগের তুলনায় এখন অধিকহারে বজ্রপাত ঘটছে। বজ্রপাতের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্দ্যেগকে বাস্তবে বাস্তবায়ন করতে বরেন্দ্র অঞ্চলে তালবীজ রোপনের উদ্যেগ গ্রহণ বার হয়েছে।
জেলা প্রশাসক ড. আমিনুর রহমান জানান, জেলায় তালের গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও একসাথে বড়বড় এতোগুলো তালের গাছ কোথাও নেই। যে কাউ সারিবদ্ধ তালের গাছগুলো দেখলে মন ভরিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির ক্ষয়রোধ, অনাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করতে তালগাছ রোপনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ জন্যে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে তাল গাছ রোপনে এগিয়ে আসতে হবে।