রাজশাহী: উত্তরাঞ্চলের অদুর ভবিষ্যতে পানির চরম সংকট দেখা দিবে। এধরনের সমস্যার কথা অনেক আগে থেকেই পরিবেশবাদিরা বলে আসছিলেন। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর বিগত এক যুগে দ্বিগুনের বেশি নিচে গেছে। অনেক আগে থেকেই উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছিল। এখন মিলছে না জমিতে সেচ দেয়ার পানিও। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে এ অঞ্চলের ১৮০টি গভীর নলকুপ। সেচ সংকটে কয়েক হাজার হেক্টর জমি পতিত পড়ে আছে।

বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ি পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। যেসব এলাকা উচু সেসব এলাকায় গত কয়েক বছরে বিএমডিএর প্রায় ১৮০ গভীর নলকূপ পুরোটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর অল্প পরিসরে কিছু পানি উঠছে বা নাজুক অবস্থায় রয়েছে ১২০টির কাছাকাছি গভীর নলকূপ। আর গত কয়েক বছর ধরে আরো গভীর বোরিং করে ঠিক করা হয়েছে ১৩০টি নলকূপ।

এদিকে, বন্ধ হয়ে যাওয়া নলকূপগুলোর আওতায় থাকা কয়েক হাজার হেক্টর জমি পতিত পড়ে আছে। কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনের জন্য বরেন্দ্র অঞ্চল জুড়ে গত আশির দশক থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। সেই পানি ব্যবহার করে খরা মৌসুমে পতিত থাকা জমিগুলোকে আনা হয়েছিল চাষের আওতায়। কিন্তু অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলনের ফলে এখন কুফল দেখা দিয়েছে। বেশি মাত্রায় পানি ব্যবহারের ফলে এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে দুই ফুট করে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে এমনটি হওয়ার কারণে পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিএমডিএর প্রধান কার্যালয় রাজশাহী অফিসের তথ্য অনুযায়ি, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। ১৯৮৫ সাল থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করে।

বরেন্দ্র অঞ্চল ১৫ হাজার ১০৫টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে উচু এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়মতপুর ও পত্নিতলা উপজেলা। এই সব উচু এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এত নিচে নেমেছে যে গত কয়েক বছরে বিএমডিএর প্রায় ১৮০ গভীর নলকূপ পুরোটা বন্ধ হয়ে গেছে।

রাজশাহী তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা মৌজার গভীর নলকূপ অপারেটর সিরিনা খাতুন জানান, তার বিএমডিএ এর গভীর নলকূপটি ২০০২ সালে স্থাপিত করে। তখন ১২৫ ফিট নিচে পানির স্তর পাওয়া গিয়েছিল। এখন ওই গভীরতায় আর পানি উঠছে না। চলতি মৌসুমে বন্ধ হয়ে আছে গভীর নলকূপটি। এতে তার নলকূপের আওতায় ২৫০ বিঘা জমি পতিত পড়ে আছে। তিনি আরও জানান, বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুন:খননেন চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ১৬০ ফিট নিচে গিয়েও পানির স্তর পাওয়া যায়নি। ফলে কোনোভাবেই চালু করা যায়নি নলকূপটি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্থাপুর উপজেলার আক্কেলপুর গ্রামের কৃষক কাউসার ও নজরুল ইসলাম জানান, আক্কেলপুর মৌজার বিএমডির গভীর নলকূপটিতে পানি কম উঠার কারণে ধান চাষ বন্ধ আছে তিন বছর ধরে। অল্প পানি উঠার কারণে অল্প সংখ্যাক জমিতে রবি শষ্য চাষ হচ্ছে। এতেও খরচ হচ্ছে দ্বিগুনের বেশি। গত ১০ বছর আগেও এই গভীর নলকূপটির আওতায় প্রায় ২০০ বিঘা জমি চাষ হতো।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার বৌদ্দপুর মৌজায় বিএমডির গভীর নলকূপ অপরেটর আব্দুল আজিজ জানান, তার মৌজার গভীর নলকূপটি পানির অভাবে গত ২ বছর ধরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ২০০ বিঘার বেশি জমি পতিত পড়ে আছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্ট্যাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি শাসন ব্যাবস্থা ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে গবেষনা করছেন। তিনি জানান, ১৯৮০ সালে পানির স্তর মাত্র ৩৯ ফুট নিচে পাওয়া যেত। ২০১৬ সালে এসে এই সব এলাকায় পনির স্তর মিলেছে ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট নিচে। ৩৫ বছরে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে।

তিনি আরো জানান, দেশে বছরে গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এই এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় রিচার্জের হার সারা দেশে ২৫ শতাংশ হলেও উত্তরাঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ বলে জানান এই গবেষক। তানোর উপজেলা বিএমডিএ প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম জানান, তানোরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ১২০ থেকে ১৩০ ফুট ডাউন দিয়ে গভীর নলকূপগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। সেই সময়ের উচু এলাকার গভীর নলকূপগুলোর অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো আবার ১৬০ থেকে ১৭০ ফুট বোরিং করে রিপেয়ার করা হচ্ছে।

Link