রাজশাহীর বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানি সংকট দীর্ঘদিনের। ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহার বাড়ানোর ব্যবস্থা না করায় চাপ পড়ে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তাই দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। এ অঞ্চলে শস্য উৎপাদন বাড়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো ১৯৬২ সালে সরকারের কাছে সুপারিশ করে। অথচ আজ পর্যন্ত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দেখা নেই। গত ও চলতি মাসেও প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় পৃথক মানববন্ধন পালিত হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। ভূমি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেচের জন্য ১৯৮৫ সাল থেকে উঁচু বরেন্দ্র ভূমিতে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি সেচকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের সাহায্যে বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে বিদ্যমান পানি সংকট নিরসন সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবি্বর সাত্তার তাপু ২০০২ সালে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি গবেষণা করেন। তিনি তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার ভূমি জটিল হওয়ায় কেবল পর্যাপ্ত পানির অভাবে মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক গুণাবলি স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে থাকায় বৃক্ষ ও শস্যাদি ক্রমাগতভাবে পানি শোষণের ক্ষমতা হারাচ্ছে। তিনি সুরাপিশপত্রে এ অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা ও শস্যক্ষেতে নিবিড় সেচ দেওয়ার লক্ষ্যে ভূ-উপরিস্থ পানির সংস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশও করেছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের অন্যতম রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ। এর নেতা মো. জামাত খান বলেন, প্রকল্পের আওতায় পদ্মা নদীর তীরে পাম্প স্টেশনের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে তা নালার মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র ভূমিতে শস্যক্ষেতসহ গৃহস্থালির কাজে নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা সম্ভব। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলের ৭৪ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে নিবিড় সেচ দেওয়া যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকল্প নকশার সূত্র উল্লেখ করে জামাত খান জানান, পাউবো ১৯৬২ সালে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারের কাছে সুপারিশ করে। প্রথমে রাজশাহী অঞ্চলের ১৫ উপজেলার ৬৭ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমি প্রকল্পাধীন বিবেচনা করা হলেও পরে বাস্তবতার নিরিখে তা বাড়িয়ে ৭৪ হাজার ৮৫০ হেক্টরে উন্নীত করা হয়। প্রকল্পের ব্যাপারে পাউবোর সাবেক প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, জাপান সরকারের সহায়তা প্রতিষ্ঠান জাইকা এ প্রকল্পের অর্থায়নে আগ্রহী। তারা ১৯৮৮-৮৯ পর্যন্ত দুই বছর নিবিড় সমীক্ষা পরিচালনা করে। জাইকার প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ৮৪৩ কোটি টাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়। এটি বাস্তবায়নে তিন বছর সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই সমীক্ষায়। তাজুল ইসলাম জানান, দেশি-বিদেশি সব সমীক্ষায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা অর্থমূল্যের আড়াই লাখ টন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হয়েছে। ভূ-উপরিস্থ পানি সুলভ ও সহজ মূল্যে পেয়ে প্রকল্প এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ উপকৃত হতো এবং লক্ষাধিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে প্রকল্পটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে জাইকার ওই সমীক্ষায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা সমীক্ষাটি পরিচালনা করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা তুলে ধরে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নিজামুল হক ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজশাহীতে ভূ-উপরিস্থ পানি যেহেতু পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে, সেখানে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কোনো প্রয়োজন নেই। উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব। এতে পানির স্তর নেমে যাওয়া রোধ করা যাবে। পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে রাজশাহী অঞ্চলে যখন গভীর নলকূপ স্থাপন শুরু হয়, তখন পানির স্তর ছিল ভূমির ৩০ ফুট নিচে। ২০ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী অঞ্চলে এখন পানির স্তর ১২ ফুট নিচে চলে গেছে। তিনি জানান, পানির স্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যাওয়ায় বিদ্যমান গভীর নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। এ বাস্তবতায় উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো বিকল্প নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৮ জুন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ মোহাম্মদ ওয়াহিদ উজ জামান পানি বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী অঞ্চলের ভুক্তভোগী মানুষদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে এক পর্যালোচনা সভা করেন। এ সভাশেষে তিনি উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পটির পুনঃসমীক্ষার নির্দেশ দেন পাউবোকে। গত ২২ অক্টোবর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া নির্দেশে বলেছে, খরাপ্রবণ রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ বাঁচাতে ও শস্য উৎপাদনে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এদিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দাবিতে গত মাসে নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাজার হাজার মানুষ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। ৫ জানুয়ারি রাজশাহীতে মানববন্ধন করে বিভিন্ন এলাকার মানুষ।