চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি : ব্যাপক হারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে অবিশ্বাস্য হারে কমছে পানির স্তর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রেকর্ড পরিমাণে ১০০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে অকেজো হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ হস্তচালিত নলকূপ। গভীর নলকূপগুলোতেও ঠিকমত পানি উঠছে না। ফলে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। ইতিমধ্যেই গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নকে পানি সংকটপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অবিশ্বাস্য হারে পানির স্তর নিচে নামতে থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে গবেষণা সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন। সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নে পানির স্তর পরিমাপের জন্য কূপ বসিয়েছিল। কূপ বসানোর সময় সেখানে পানির স্তর ছিল ১০১ ফুট নিচে। মাত্র দুই বছর পর এ বছর প্রায় ১০৯ ফুট নিচে পানির স্তর পাওয়া গেছে। দুই বছরে ৮ ফুট নিচে চলে গেছে পানির স্তর। শুধু ঝিলিম ইউনিয়নই নয়, নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলাসহ পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে এভাবেই কমছে পানির স্তর।

ডাসকোর কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এক যুগ আগেও এসব অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে কোথাও কোথাও ১৫০ ফুট বা তারও নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। জমিতে সেচের জন্য বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিএমডিএর গভীর নলকূপের মাধ্যমে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই বরেন্দ্র এলাকায় পানির এমন ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও ঝিলিম ইউনিয়ন এলাকায় ৩২টির অটো রাইস মিল রয়েছে। এসব মিলে প্রায় দেড়শ গভীর নলকূপ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ মিঠাপানি ব্যবহার করা হচ্ছে। মিলগুলো তাদের প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহার করতে ভূগর্ভের অনেক গভীর থেকে পানি উত্তোলন করায় সংকট আরো বাড়ছে বলে জানিয়েছে ডাসকো ফাউন্ডেশন। ঝিলিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তসিকুল ইসলাম তসি জানান, পানি সংকটের কারণে তার ইউনিয়নের এক হাজারের বেশি হস্তচালিত নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। এর ফলে আমনুরা বাজার, ঝিলিম বাজার, মিয়াপাড়া, কেন্দুল, গসিরাপাড়া, ধিনগর, আতাহার, বাবুডাইং, জামতলাসহ এর আশপাশের গ্রামগুলো খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেককেই দূর দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কৃষি জমিতে সেচ ও খাওয়ার পানির সংকট আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।

এদিকে ভূগর্ভ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার জন্য জেলার দুই প্রধান নদী পদ্মা ও মহানন্দার পানি শূন্যতাকেও দায়ী করেছেন পরিবেশবিদরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারী সংগঠন সেভ দ্য ন্যাচারের সমন্বয়ক রবিউল হাসান ডলার জানান, প্রতিটি নদ-নদীর উজানে ভারত বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে ভূগর্ভে পানির রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলেই নয়, পুরো জেলাতেই পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী বাহার উদ্দিন মৃধা জানান, সদর উপজেলার ঝিলিম, বালিয়াডাঙ্গা ও গোবরাতলা, নাচোল উপজেলার নাচোল, কসবা, ফতেপুর ও নেজামপুর এবং গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর, রহনপুর ও চৌডালা ইউনিয়নে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। এসব ইউনিয়নে পানির স্তর ১৩০ ফুটের নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত নলকূপগুলো দিয়ে পানি উঠছে না।

বিষয়টি নিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুন অর রশিদের সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি জানান, ভূগর্ভের পানি উত্তোলন বন্ধ করে কিভাবে উপরিভাগের পানিকে সেচের কাজে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে এখন কাজ করছেন তারা। এছাড়া কম সেচ লাগে, এমন ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধও করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।