এবারো শুস্ক মৌসুম শুরুর আগেই শুকিয়েছে পদ্মা। বিশাল বিশাল চর জেগে প্রমত্তা পদ্মা যেন পরিনত হয়েছে মরা নদীতে। আর এর প্রভাবে পদ্মা সঙ্গে সংযোগ রাজশাহী অঞ্চলের এমন ১২ নদীও পরিনত হয়েছে মরা খালে। শুকিয়ে গেছে খালবিল। কিন্তু এ অঞ্চলে পানি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়। গত ৩০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি পানি সংরক্ষণের জন্য চলনবিল ও উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প। ফলে দ্রুত নেমে যাচ্ছে এ অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্ত পানির স্তর। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি, সেচ, মৎস্য ও পরিবেশ।

এ অঞ্চলের হাজার হাজার হস্ত চালিত নলকুপ অকেজো হয়ে পড়ে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। উজানের নদী কেন্দ্রিক পরিকল্পনা আর এ অঞ্চলে পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য রাজশাহী অঞ্চলে পানি কেন্দ্রীক বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেয় বলেও মনে করেন তারা। রাজশাহী শহরের পাশেই যেখানে পদ্মা কলকলিয়ে স্রোতস্বীনি রুপ আর নৌকা থাকার কথা ছিল সেখানে এখন চলছে ট্রাক। জেগে উঠা বিশাল বিশাল চরে চাষ করা হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। কিন্ত এক সময় এখানেই ছিল পদ্মার মূল স্রোতধারা। উজানের নদী কেন্দ্রীক কর্মপরিকল্পনাগুলোর প্রভাবে বিশাল বিশাল চর জেগে যাওয়ায় পদ্মার মূল স্রোতধারা প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার ভারতের দিকে সরে গেছে। ফলে এ অঞ্চলে দেখা দিয়েছে এর বিরুপ প্রভাব।

মরা খালে পরিনত হয়ে পদ্মার সঙ্গে সংযোগ ১২টি নদী। শুস্ক মৌসুমের অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে খালবিল। আর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়াসহ রুক্ষ আর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এখাকার পরিবেশ। বেকার হয়েছে এ অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে ও মাঝি। পানি প্রত্যাহারের জন্য ভারত ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উলে¬খযোগ্য হলো, ভাগীরথি নদীর উপর জঙ্গিপুরের ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলী ও ভাগিরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। এর ফলে হুগলী নদীর নাব্যতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি সারা বছর সচল থাকে কোলকাতা নদী বন্দর।

অন্যদিকে ভাগিরথী নদীর বাড়তি পানি ব্যবহার করে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকায় জুড়ে। এছাড়াও ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর ব্যারেজ এবং উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য আরো প্রায় চারশত পয়েন্ট দিয়ে পানি সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছে। শুকনো মৌসুমে এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে। আর এর প্রভাবে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে যায়। আর এর প্রভাব পড়েছে পদ্মা ছাড়াও রাজশাহী অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রভাহিত মহানন্দা, আত্রাই, বারনই, শীব ও রাণী (ফকিন্নী), ছোট যমুনাসহ ১২ নদীতে। এসব নদীতে পলি ও বালি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এখন প্রায় মৃত। শুস্কু মৌসুমের আগেই নদীগুলো শুকিয়ে যায়। কিন্তু আশির দশক পর্যন্ত এসব নদীতে শুস্ক মৌসুমেও পানি থাকতো। আর সে পানি ব্যবহার করা হতো কৃষি জমির সেচ কাজের জন্য। জেলেরা মাছ শিকার করতে, চলতো নৌকাও।

এছাড়াও রাজশাহী অঞ্চলের অন্তত ২০ খালও এখন সম্পূর্ণ মৃত অবস্থায় রয়েছে। যা এখন চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে। সেসব খালে এখন চাষ করা হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। আর খনন না করায় শুস্ক মৌসুমের আগেই শুকিয়ে যায় এ অঞ্চলে কয়েক হাজার পুকুর। কিন্তু গত ৪০ বছরেও এসব নদী, খাল ও সরকারি বেসরকারি পুকুরগুলো খনন বা সেগুলোতে পানি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে ৭০ দশকের শেষ দিকে এবং ৮০ দশকের প্রথম দিকে কিছু খাল খনন করা হলেও তা কোনই কাজে আসেনি। ফলে এ অঞ্চলের কৃষির সেচ ব্যবস্থা সম্পন্ন নির্ভর হয়ে পড়েছে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর। এতে ভূ-গর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত মাত্রায় নিচে নেমে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. সারোয়ার জাহান সজল বলেন, উজানের নদী কেন্দ্রীক পরিকল্পনার কারণে পলি জমা হয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে পদ্মা নদী। আর এর প্রভাবে এ অঞ্চলের ১২টি নদী এখন মৃত প্রায়। পদ্মাসহ এসব নদী সংস্কারের জন্য কোন সরকারই পদক্ষেপ নেয়নি। পানির এ সংকট কাটাতে নদীগুলো খননের মাধ্যমে মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ ও ও রাজবাড়ির পাংশায় ব্যারেজ নির্মাণের বিকল্প নেয়। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর উৎস ভারতে অবস্থিত। আর ভারতের নদী অববাহিকা কেন্দ্রীক অর্ধশতাধিক পরিকল্পনা রয়েছে। পানি কেন্দ্রীক এসব পরিকল্পনা গ্রহন করে ভারত তা একের পর এক বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তাদের পানি কেন্দ্রীক এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে শুস্ক মৌসুমের শুরুতেই বাংলাদেশের নদী ও খালবিল পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। আর এর প্রভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষি, সেচ, মৎস্য ও পরিবেশ। ফলে পানি সংরক্ষনের জন্য ভারতের মতো বাংলাদেশেও পানি কেন্দ্রীক বৃহৎ পরিকল্পনার বিকল্প নেয় বলেও তিনি মনে করেন।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, কোন সরকারই রাজশাহী অঞ্চলে পানি সংরক্ষনের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রাহন করেনি। পানি সংরক্ষনের জন্য প্রকল্প গ্রহনের ৩০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি চলনবিল ও উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প। ফলে এ অঞ্চলে কৃষকরা সম্পন্ন নির্ভর হয়ে পড়েছে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর। এ অঞ্চল মরু করণ প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা করতে ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।

রাজশাহী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্তমানে গড়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ১১০ ফুট নিচে অবস্থান করছে। গত বছর এ সময় পানির স্তর ছিল ১০০ থেকে ১০৫ ফুট নিচে। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটির সমতল থেকে ১৩০ ফুট নিচের যে পাথর অবস্থান করছে সেখান থেকে মাত্র ১৫ ফুট উপরে পানির স্তর অবস্থান করছে। এই স্তর যদি আর ৫ থেকে ১০ ফুট কমে যায় তবে এ অঞ্চলে হাজার হাজার গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়বে। সুত্র মতে, ভু-উপস্থ পানি সংরক্ষন কমে যাওয়ায় এবং গভীর নলকূপের সাহায্যে নির্বিচারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন, বৃষ্টিপাত একে বারেই কমে যাওয়াসহ নানা কারণে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে গত ২৫ বছরে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১৯৮৫ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে পানির স্তর ছিলো ৪৪.৬৭ ফুট নিচে। ১৯৯১ সালে তা নেমে দাড়ায় ৪৮ ফুটে। এছাড়াও ২০০৬ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে সর্বনিম্ন পানির স্তর ছিলো ৮৫ ফুট। যা ২০০৭ সালে ৯৩.৩৪ ফুট, ২০০৯ সালে নেমে যায় ৯৫ ফুট, ২০১০ সালে ১০০ ফুট এবং ২০১১ সালে ১০৫ ফুট নিচে।

Link