রুক্ষ প্রকৃতির বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় বছরে প্রধানত একটাই ফসল চাষ হতো। বর্ষা মৌসুমে ধান চাষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এখানকার কৃষি। ভালো উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল এ অঞ্চল। সেচের চাহিদা মেটাত বৃষ্টির পানি। কিন্তু দিন বদলেছে। প্রকৃতিনির্ভর কৃষি হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মেটাতে ধান উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পায়। এতে উৎসাহ জোগাতে এগিয়ে আসে সরকার। বরেন্দ্রসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার ১২৫টি উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। সেটা কয়েক দশক আগের কথা। সমুদৃপৃষ্ঠ থেকে ১২০ ফুট ওপরে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাটির ১৫০ ফুট নিচে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। সারা দেশের গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত অর্ধেকেরও কম। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার প্রকৃতি-পরিবেশ, জীবন-জীবিকা ভিন্ন ধরনের। বিএমডিএর শুরুতে অগভীর নলকূপে তোলা পানি দিয়ে সেচের চাহিদা মেটাতে থাকায় ধান উৎপাদন বাড়তে থাকে। বছরে একবারের স্থলে দুবার, তিনবারও উৎপাদন হতে থাকে। দেশ যে আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে তাতে বরেন্দ্র অঞ্চলের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। একই সঙ্গে উচ্চফলনশীল জাতের কারণে ধান উৎপাদন দ্রুত বাড়তে থাকে। এ ধারা অব্যাহত থাকায় সেচের পানির ক্রমবর্ধমানে চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ এমনই হয়ে ওঠে যে পানির স্তর দ্রুত নামতে থাকে। ফলে অগভীর নলকূপ কার্যকারিতা হারায়। বাড়তে থাকে গভীর নলকূপের ব্যবহার। এখন বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে ১৫ হাজারেরও বেশি গভীর নলকূপ সেচের চাহিদা মেটাচ্ছে। এটা বিএমডিএর অবদান। সাফল্যও বলা যায়। ফলে ধানের উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও অস্বাভাবিকভাবে নেমে যায়। মাটি খুঁড়ে কুয়ার ভেতর নলকূপ বসাতে হয়। অনেক স্থানে এতেও পানি ওঠে না। এই পানিশূন্যতা গ্রীষ্মকালে হয়ে ওঠে ভয়াবহ। আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট হতে থাকে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে এটা সহজেই চোখে পড়ে। এখানে নলকূপে খাওয়ার পানি-সংকট জনজীবনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়। গাছের ডাবে পানি থাকে না। আমের মুকুল ঝরে পড়ে। রুক্ষতা বৃদ্ধির ফলে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। এসব ঠেকাতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ে। জ্বালানি খরচসহ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বাজারে ধানসহ উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম পড়ে গেলে মাথায় হাত ওঠে কৃষকের। সেচ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধিতে মাটির উর্বরতা শক্তি কমতে থাকে। বেড়ে যায় সার-কীটনাশকের ব্যবহার। উৎপাদিত ফল, ফসল, শাকসবজিতে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ সামাজিক সমস্যা প্রকট হতে থাকে। অলাভজনক হওয়ার কারণে ধান উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে কৃষক অন্যদিকে ঝুঁকে পড়েন। ২০১৪-১৫ সালে রাজশাহী জেলায় যেখানে ধান চাষ হয়েছে ৭০ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে, সেখানে পরের বছর তা নেমে আসে ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টরে। আর চলতি ২০১৬-১৭ সালে এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭২৫ হেক্টরে। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ তথ্যই বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। পাশাপাশি বেড়েছে রবিশস্য, আলু, টমেটো, ডাল-জাতীয় শস্য, ফল ও ফুলের মতো বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন। ২০১৫-১৬ মৌসুমে যেখানে গম, আলু, মসুর, ছোলা, মাসকলাই, খেসারি, জাতীয় ফসল আবাদ হয়েছে ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে। আর ২০১৬-১৭ মৌসুমে এ ধরনের ফসল আবাদ হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে। পানি কম লাগে বলে ব্যাপকভাবে বাড়ছে আলু, টমেটো চাষ। গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ জমিতে এবার আলুর চাষ হয়েছে। ফল-বাগানের পরিমাণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০১৩-১৪ মৌসুমে সব মিলিয়ে রাজশাহীতে বিভিন্ন জাতের ফলের আবাদ হয়েছিল ২২ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমিতে। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ০৩ হেক্টরে। আর ২০১৫-১৬ মৌসুমে ২৭ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে ফলের বাগান গড়ে ওঠে। কৃষি উন্নয়ন অধিদপ্তরের হিসাবমতে এভাবে প্রতিবছর বাড়ছে আম, লিচু, পেয়ারা, কুল জাতীয় ফলের বাগান। ফলে শস্যভান্ডারখ্যাত রাজশাহী অঞ্চল এখন ফলভান্ডারে পরিণত হতে চলেছে। এর পাশাপাশি আবাদি জমিতে পুকুর কাটার হিড়িক পড়ে গেছে। লাভজনক হওয়ায় মাছ চাষে আগ্রহের কারণে মাছ চাষের প্রসার চোখে পড়ার মতো। পুকুরে চাষ করা জ্যান্ত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও বাজার পেয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় জীবিত মাছ বিক্রিতে দেশে রাজশাহী এর মধ্যেই বেশ নাম করেছে। পানি-সংকট এভাবে পাল্টে দিয়েছে বরেন্দ্র তথা উত্তরাঞ্চলের কৃষির চরিত্র। বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষির এই পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক আছে। ধান উৎপাদন কমে গেলে তা দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও রপ্তানিতে হুমকি সৃষ্টি করবে। আবার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে যেভাবে ধানের উৎপাদন বেড়েছে, সেটাও পরিবেশ ও প্রকৃতির বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। শুরু থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি-সংকট মোকাবিলায় ভূ-উপরিস্থ পানি বিশেষ করে নদী, খাল-বিল, পুকুরসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি ব্যবহার এবং বেশি পানি লাগে এমন শস্যের বদলে কম পানির শস্য আবাদের পথ ধরলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। অবশ্য এখন এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে বিএমডিএ। কৃষিমন্ত্রী নতুন করে গভীর নলকূপ স্থাপনে নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছেন বিএমডিএকে। অথচ বরেন্দ্র অঞ্চলের আজকের পরিস্থিতির জন্য বিএমডিএর ভূমিকাই প্রধান। সরকার থেকেও সর্বাত্মক সমর্থন-সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। দ্রুত ধান উৎপাদন বৃদ্ধির কৃতিত্বও দাবি করা হয়েছে। এ কৃতিত্বের পেছনে ছুটতে গিয়ে অদূরদর্শী, অপরিকল্পিত পদক্ষেপ যে আখেরে বিপদে ডেকে আনে, সেটা বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির গতিপ্রকৃতি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয়। দেশজুড়ে আজ যে উন্নয়নের জোয়ার তোলা হয়েছে, তার পরিণতি বিবেচনায় বরেন্দ্রর এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে বলেই আমাদের ধারণা।

Link